সাদমান আরেফিন ফাহিম ও মো. ইরতেজা হাসনাত লাবিব কক্সবাজারের পৃথক দুইটি কলেজের শিক্ষার্থী। যাদের মধ্যে ফাহিম কক্সবাজার সরকারি কলেজের একাদশ শ্রেণীর মানবিক বিভাগের ছাত্র। আর লাবির কক্সবাজার সিটি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর বিজ্ঞান বিভাগের। কলেজ এবং শ্রেণী বিভিন্ন হলেও রামু উপজেলার পাশাপাশি গ্রামের সন্তান। দুই জনই নিঃসঙ্গ এবং একাকি সময় কাটাতে পছন্দ করলেও ব্যস্ত থাকতেন মোবাইল ফোন নিয়ে। অথচ দুই জন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক সহ অন্য মাধ্যমে তেমন সক্রিয় ছিল না।
গত ২৬ জুলাই সকালে নিজ নিজ কর্মের কথা বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর নিখোঁজ হয়ে যায় দুই জনই। ২০ দিন পর উভয়ের পরিবার জানতে পারেন সিলেটের মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার কালো পাহাড় থেকে স্থানীয়দের সহায়তায় জঙ্গি সংশ্লিষ্টতায় গ্রেপ্তার করা ১৫ জনে এই ২ জনও রয়েছে। পরিবারের ধারণারও বাইরে ছিল ২ সন্তান জঙ্গি সংশ্লিষ্টতায় জড়িয়ে গেছে।উভয়ের পরিবারের সাথে আলাপ করে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
এই ২ জনের মধ্যে সাদমান আরেফিন ফাহিম কক্সবাজারের রামু উপজেলার ফতেখাঁরকুল ইউনিয়নের দক্ষিণ শ্রীকুল গ্রামের ব্যবসায়ী হামিদুল হকের ছেলে এবং মো. ইরতেজা হাসনাত লাবিব একই ইউনিয়নের মধ্যম মেরংলোয়া গ্রামের মোহাম্মদ এনামুল হকের ছেলে। রামু উপজেলা সদরের চৌমুহনীর খুব কাছের গ্রাম মধ্যম মেরংলোয়ার এনামুল হক ও নাছিমা খানম দম্পতি একটি শিক্ষক পরিবার। স্বামী-স্ত্রী দুই জনই স্কুল শিক্ষক।
শুক্রবার সকালে লাবীবের মা প্রাইমারি স্কুল শিক্ষিকা নাছিমা খানম বলেন, ‘আমার টুইন বেবী ছিল। আমি যখন আট মাসের অস্তঃসত্তা তখন পেটে আমার একটা বেবী মারা যায়। এর একমাস পর জন্ম হয় লাবিবের। অনেক কষ্ট করে ছেলেটা জন্ম দিয়েছি, মানুষ করছি। এখন ভেবে নিয়েছি, আমার একটা ছেলে পেটে মারা গেছে, আরেকটি ছেলে মরে গেছে। এখানে শেষ, আমরা কোনো জঙ্গি ছেলের দায় নেবো না। তিনি আরও বলেন,এখন রাষ্ট্র যে সিদ্ধান্ত দেবে সেটাই হবে।আমরা রাষ্ট্রের কর্মচারী, রাষ্ট্রের কাছে দায়বদ্ধ। লাবিবের মা বলেন,কলেজে ভর্তি হওয়ার পর একদম পড়াশোনা করতো না। আচরণেও কিছুটা পরিবতন আসে। সারাদিন বাসায় রুমে বসে মোবাইলে গেম খেলতো। ঝগড়া করে একটি মোবাইল ভেঙে পেলে। লাবিব বলতো, আমাকে সহ্য করতে না পারলে ত্যাজ্য করে দাও। তাকে বেশ কয়েকবার বেত্রাঘাত করা হয়েছিল।
লাবিবের বাবা মোহাম্মদ এনামুল হক বলেন, ২৬ জুলাই সকালে আমি ও তার মা স্কুলে যাই। বিকেল পাঁচটায় বাসায় ফিরে দেখি কলেজে যাওয়ার ব্যাগে কিছু কাপড় নিয়ে বেরিয়ে গেছে লাবিব। পড়াশোনায় মনোযোগী হতে চাপ দিলে এর আগেও ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল লাবিব। কিন্তু দুদিন পর ফিরে এসেছিল। তাই তাৎক্ষণিক নিখোঁজের বিষয়টি থানায় জানানো হয়নি। এছাড়া ১৭ তারিখ এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়ার কথা ছিল। আমি এডমিট কার্ডের জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও যোগাযোগ করি। এবং সিদ্ধান্ত নিই, ১৭ আগস্ট না এলে প্রশাসনকে জানাবো। এর মধ্যে বুধবার খবর আসে, জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে মৌলভীবাজারে গ্রেপ্তার হয়েছে লাবিব।
একই ইউনিয়নের আরেকটি গ্রাম দক্ষিণ শ্রীকুল। ওই গ্রামের হামিদুল হক দীর্ঘ ২১ বছর সৌদি আরবে কাটিয়ে ২০১৪ সালের মার্চে দেশে ফিরেছেন। বিয়েও করেন ছিকলঘাট থেকে। এরপর শুরু করেন সুতোর ব্যবসা। যা দিয়ে ভালোই চলছিল সংসার। বড় ছেলে ফাহিম জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ায় খবরটি শুনে খুব লজ্জিত পিতা হামিদুল হক। ছেলে ঠিক কবে থেকে এ কাজে জড়িয়ে গেছেন টের পাননি তিনি। হামিদুল হক আরও বলেন, ‘ফাহিম রামু খিজারী উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়ার পর ভর্তি হয় রামু কলেজে। তবে আমাদের ইচ্ছেতে পরের বছর ভর্তি হয় কক্সবাজার সরকারি কলেজে। ফাহিম কলেজে ভর্তির পর পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়ে উঠে। সারাদিন বাসায় বসে থাকতো। পরে তাকে ব্যস্ত রাখতে চাকুরি করতে বলা হয়েছিল। গত ২৬ মার্চ মাসে ৩ হাজার টাকা বেতন ও পণ্য ডেলিভারির কমিশনের ভিত্তিতে কক্সবাজার শহরের ‘পাঠাও কুরিয়ার সার্ভিস এ চাকুরি নেন ফাহিম। সেখান থেকে ২৫ জুলাই বাড়িতে যায়, পরদিন ২৬ জুলাই থেকে নিখোঁজ হয়। ফাহিম একা থাকতে পছন্দ করত, প্রায়শ ব্যস্ত থাকতো মোবাইল ফোন নিয়ে। তবে সে কিছুদিন কক্সবাজার শহরের একটি ম্যাচে থাকতেন। ফাহিম নিখোঁজের পর থানায় কিংবা প্রশাসনের কাউকে অবহিত করেননি হামিদুল হক। তবে তিনদিন পর স্থানীয় চেয়ারম্যানকে বিষয়টি মৌখিকভাবে জানান মামা জাফর আলম। মা হাসিনা বেগমের ধারণা, তার ছেলেকে কেউ মগজধোলাই করে বিপথগামী করেছে। বাসায় সে একটি ইসলামীক বই নিয়মিত পড়াশোনা করতেন।
‘পাঠাও কুরিয়ার সার্ভিস’ কক্সবাজার অফিসের কর্মকর্তা রানা দাশ বলেন, ফাহিমের ঘনিষ্ঠজন ইমরান থেকে একবার খোঁজ নিই, পরে আর নিইনি। কর্মচরীরা অফিসে আসবে, কাজ করবে, হিসাব দেবে এটুকু। এরই বাইরে কারো ব্যক্তিগত বিষয়কে গুরুত্ব দিইনি।’
ফতেখাঁরকুল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম ভুট্টো বলেন, ফাহিমের মামা জাফর আলম আমার ঘনিষ্ঠজন। সে আমাকে জানায় যে, ফাহিমকে পড়াশোনায় চাপ দেয়ার বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। এর মধ্যে বুধবার গ্রেপ্তার হওয়ার বিষয়টি জেনেছি।’
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম বলেন, রামু থানার দুজন শিক্ষার্থী জঙ্গি সম্পৃক্ততার বিষয়টি জানতে পেরেছি। তাদের এলাকাগুলোতে তৎপরতা শুরু করেছে। যেখানে তাদের চলাচল বেশি ছিল, সেসব এলাকায় পুলিশ তৎপরতা চলছে। পাশাপাশি দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও নজরদারি বাড়ানো হবে। একই সাথে কারা কারা তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত, সেসব ব্যক্তির ব্যাপারে নজরদারি করা হচ্ছে।’
গত মঙ্গলবার সিলেটের মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার কর্মধায় থেকে স্থানীয়দের সহায়তায় ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)।
সিটিটিসি ইউনিটের প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান সংবাদ মাধ্যমে জানিয়েছেন ‘গ্রেপ্তাররা নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলা’র সদস্য। তাদের বিশ্বাস, ইমাম মাহমুদের নেতৃত্বে ভারতীয় উপমহাদেশে জিহাদের নেতৃত্ব দেয়া হবে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারা জানায় যে, ঘরছাড়া সবাই কথিত ইমাম মাহমুদের নেতৃত্বে পাহাড়ে জঙ্গি প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে যোগ দেয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলেন। এদিকে গ্রেপ্তার ১৫ জনকে গত বুধবার থেকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে।